রাসূলুল্লাহ ﷺ সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত। তিনার জন্ম যে কোনো মুসলিমের কাছে আনন্দের বিষয়—এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নবীর জন্মদিনকে বিশেষ দিন হিসেবে উদযাপন করা বা “ঈদে মিলাদুন্নবী” পালন করা কি ইসলামে অনুমোদিত?
এই প্রশ্নে মুসলিম বিশ্বে বড় ধরনের মতভেদ রয়েছে। একদল বলেন এটি বিদআত, অন্যদল বলেন শর্তসাপেক্ষে জায়েজ। আমাদের জন্য জরুরি হলো বিষয়টি কুরআন, সহীহ হাদীস ও আলেমদের বক্তব্য থেকে যাচাই করা।
ইসলামে ঈদের ধারণা
প্রথমেই মনে রাখা দরকার, ইসলাম কেবল দুটি ঈদ নির্ধারণ করেছে—ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। সহীহ হাদীসে এসেছে, রাসূল ﷺ মদিনায় এসে দেখলেন মানুষ দুটি উৎসব পালন করছে। তিনি বললেন:
“আল্লাহ তোমাদের সে দুটি উৎসবের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি উৎসব দিয়েছেন—ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।”
— (আবু দাউদ: ১১৩৪)
এইজন্য ইসলামে ঈদের সংখ্যা সীমিত। এর বাইরে নতুন ঈদ বানানো হলে তা দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু যোগ করার মতো হবে।

রাসূল ﷺ তাঁর জন্মদিনে কী করতেন?
রাসূলুল্লাহ ﷺ সরাসরি নিজের জন্মদিন পালন করেননি। তবে তিনি সোমবারে রোজা রাখতেন। যখন সাহাবীরা কারণ জিজ্ঞেস করলেন, তিনি বললেন:
“এ দিনেই আমি জন্মগ্রহণ করেছি, আর এ দিনেই আমার প্রতি ওয়াহী নাযিল হয়েছে।”
— (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, নবীর জন্মদিন স্মরণ করা যায়, তবে সেটা রোজা বা ইবাদতের মাধ্যমে, কোনো উৎসব করে নয়।
সাহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গি
সাহাবীদের মধ্যে কেউই নবীর জন্মদিন আলাদাভাবে পালন করেননি। তাঁরা প্রতিদিনই তিনার দেওয়া শিক্ষা মেনে চলতেন, তিনার স্মৃতি রক্ষা করতেন। তাঁরা নবীর জন্মের তারিখকে কেন্দ্র করে বিশেষ সমাবেশ, শোভাযাত্রা বা মেলা আয়োজন করেননি।
অর্থাৎ, সরাসরি সাহাবীদের আমলেই প্রমাণ মেলে না যে তাঁরা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করেছেন।
নবীর জন্ম ও ওফাতের তারিখ নিয়ে মতভেদ?
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, নবী ﷺ–এর জন্মতারিখ নিয়ে আলেমদের ভিন্নমত রয়েছে।
- অনেকে বলেন ১২ রবিউল আউয়াল, আবার কেউ বলেন ৮, ৯ বা ২ রবিউল আউয়াল।
- তাই সঠিকভাবে কোন দিন নবী ﷺ জন্মগ্রহণ করেছেন—এ বিষয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নেই।
কিন্তু নবী ﷺ–এর ওফাতের তারিখে সকলেই একমত। তিনি ইন্তেকাল করেছেন ১২ রবিউল আউয়ালেই।
এর মানে দাঁড়ায়, যেদিন বহু মানুষ “ঈদে মিলাদুন্নবী” পালন করেন, সেটি আসলে তাঁর ইন্তেকালের দিনও বটে।
মৃত্যুর দিনে ঈদ পালন কতটুকু জায়েজ?
ইসলামে কোনো নবীর মৃত্যুর দিনকে আনন্দের দিন বানানোর শিক্ষা নেই। বরং মৃত্যুর দিন হলো শোক ও শিক্ষা নেওয়ার দিন।
📖 নবী ﷺ বলেছেন:
“তোমরা ইহুদী-খ্রিস্টানদের মতো করো না, যারা তাদের নবীদের কবরকে ঈদ বানিয়েছে।”
— (সহীহ বুখারী: ১৩০৬, সহীহ মুসলিম: ৫২৪ )
তাহলে প্রশ্ন আসে—একই দিনে যখন নবীর ইন্তেকাল ঘটেছে, তখন সেটিকে “ঈদ” বানানো কতটা যৌক্তিক? আলেমরা বলেন, এটি দ্বীনের প্রকৃত রূপকে বিকৃত করার মতো।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ
📖 আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার মাধ্যমে, এর জন্যই তারা আনন্দ প্রকাশ করুক।”
— (সূরা ইউনুস: ৫৮)
অনেকে বলেন, এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে নবীর জন্মে আনন্দ প্রকাশ করা জায়েজ।
কিন্তু অন্য আলেমরা বলেন—এ আয়াত আসলে কুরআনের নাজিল হওয়া নিয়ে বলা হয়েছে, জন্মদিন উদযাপন নয়।
হাদীসে এসেছে:
“যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু উদ্ভাবন করবে, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে তা প্রত্যাখ্যাত।”
— (সহীহ বুখারী: ২৬৯৭, সহীহ মুসলিম: ১৭১৮)
এই হাদিসের মানে দাঁড়ায়, ইসলামে যা নেই, তা দ্বীনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়।
বড় আলেমদের মতামত:
যারা বিদআত বলেছেন
- ইমাম মালিক (রহ.): “যা রাসূল ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণ করেননি, সেটিকে দীন বানানো বিদআত।”
- শায়খ ইবনে তাইমিয়্যা (রহ.): “মিলাদ উদযাপন বিদআত। তবে কেউ যদি ভালোবাসার কারণে নবীকে স্মরণ করে এবং হারাম কাজ না করে, তবে তার মাঝে কিছু সওয়াব থাকতে পারে।” — (ইকতিদা সিরাতুল মুস্তাকীম)
- শায়খ ইবনে বায (রহ.): “মিলাদ উদযাপন শরীয়তে ভিত্তিহীন।”
যারা শর্তসাপেক্ষে জায়েজ বলেছেন
- ইমাম সুয়ূতি (রহ.): “যদি মিলাদে গান-বাজনা, অপচয় না থাকে, বরং দরুদ, সীরাত আলোচনা হয়, তবে তা নেক কাজ হতে পারে।”
- শায়খ আহমদ শিহাবুদ্দীন (রহ.): “নবীর জন্মদিনে তাঁর সীরাত আলোচনা করা জায়েজ, যদি এটিকে ঈদের মতো বাধ্যতামূলক আমল মনে না করা হয়।”
বিদআতের ধরন
আলেমরা বিদআতকে দুই ভাগে ব্যাখ্যা করেনঃ
- বিদআতে সাইয়্যা (খারাপ বিদআত): যেমন নতুন ঈদ উদযাপন করা, গান-বাজনা, অপচয়।
- বিদআতে হাসানা (ভালো বিদআত): যেমন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, ইসলামী বই ছাপানো, দরুদ মাহফিল, যদি এগুলোকে দ্বীনের নতুন ফরজ মনে না করা হয়।
মিলাদুন্নবী নিয়ে মতভেদ মূলত এখানেই—কেউ একে বিদআতে সাইয়্যা বলেন, কেউ বিদআতে হাসানা বলেন।

আধুনিক সমাজে মিলাদুন্নবী
আজকের দিনে আমরা দেখি—
- কোথাও মিলাদ পালিত হয় কেবল কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ, নবীর সীরাত আলোচনা ও দোয়া-মোনাজাতের মাধ্যমে।
- আবার কোথাও এটিতে যোগ হয় বিশাল শোভাযাত্রা, আতশবাজি, গান-বাজনা, যা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তাই বলা যায়, মিলাদ পালন যদি হয় ইবাদতের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিন বানিয়ে, তবে তা বিদআত। কিন্তু নবীর সীরাত আলোচনা, দরুদ পাঠ, দোয়া করা সবসময়ই জায়েজ।
সহজ ভাষায় বোঝার উপায়
- নবীর জন্মদিনকে “ঈদ” বানানো বিদআত।
- নবী ﷺ নিজে সোমবারে রোজা রেখে তাঁর জন্ম স্মরণ করতেন।
- সাহাবীরা কখনো আলাদা করে উদযাপন করেননি।
- জন্মদিনে মতভেদ থাকলেও, ওফাতের দিন ১২ রবিউল আউয়াল নিশ্চিত।
- মৃত্যুর দিনে ঈদ পালন শরীয়তে নেই।
- ভালোবাসা প্রকাশ সর্বদা জায়েজ, তবে নতুন উৎসব বানানো সঠিক নয়।
শেষ কথা:
ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে নিরপেক্ষভাবে বলা যায়ঃ
- নবীর জন্ম আনন্দের বিষয়, তাঁকে স্মরণ করা ভালো।
- কিন্তু এটিকে আলাদা ঈদ হিসেবে পালন করা ইসলামে নেই।
- যদি কেউ এদিনে সীরাত আলোচনা, দরুদ পাঠ, কুরআন তিলাওয়াত করে, তবে তা ভালো কাজ।
- তবে শোভাযাত্রা, গান-বাজনা, আতশবাজি, অপচয় সবই বিদআত ও হারাম।
- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—১২ রবিউল আউয়াল শুধু জন্মদিন নয়, বরং নবীর ইন্তেকালের দিনও। তাই এই দিনে “ঈদ” করা ইসলামের শিক্ষা নয়।
তাই একজন মুসলিমের জন্য উত্তম হলো—নবীর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রতিদিনই প্রকাশ করা, শুধু একদিনে সীমাবদ্ধ নয়।