মোহরানা সম্পর্কিত ইসলাম কি বলে এবং এর প্রয়োজনীয়তা কি?

বিবাহ ইসলাম ধর্মে একটি পবিত্র চুক্তি, যা কেবল পুরুষ ও নারীর মধ্যে ভালোবাসা ও সহবাসের সম্পর্ক তৈরি করে না; বরং এটিকে সমাজের স্থিতিশীলতা, পারিবারিক শান্তি এবং দায়িত্বশীলতার ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলে। ইসলামে বিবাহকে সহজ করা হলেও এর মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ। আর এই বিবাহ চুক্তির একটি অপরিহার্য অংশ হলো মোহরানা বা দেনমোহর

মোহরানা হলো স্ত্রীর জন্য স্বামীর পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি অধিকার। অনেকেই একে কেবল আর্থিক দায় মনে করেন, কেউ কেউ আবার অতি ভারী পরিমাণ নির্ধারণ করে অযথা জটিলতা তৈরি করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রেই এটি অবহেলিত হয়। অথচ কুরআন ও হাদীসে মোহরানা সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামে মোহরানা নারীর সম্মান, মর্যাদা, আর্থিক সুরক্ষা এবং পারিবারিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করার প্রতীক।

মোহরানা সম্পর্কিত ইসলাম

মোহরানার সংজ্ঞা (কুরআনের আলোকে)

মোহরানা বা সদাক হলো, বিবাহের সময় স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত নির্ধারিত সম্পদ বা প্রতিশ্রুতি, যা ইসলামে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি স্ত্রীর অধিকার, যা তিনি চাইলে গ্রহণ করবেন বা মাফ করতে পারেন।

📖 আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আর তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহরানা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদান কর।”
(সূরা আন-নিসা: আয়াত ৪)

অন্যত্র বলা হয়েছে:
“আর তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সাথে যে ভোগ করবে, তাদের নির্ধারিত মোহরানা তাদেরকে প্রদান কর। তবে যদি তারা নিজেরা খুশিমনে কিছু ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা আনন্দের সাথে গ্রহণ কর।”
(সূরা আন-নিসা: আয়াত ২৪)

প্রদত্ত আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, মোহরানা কোনো প্রথাগত প্রথা নয়; বরং এটি আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার।


রাসূল ﷺ এর আমল ও শিক্ষা

রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর স্ত্রীদের মোহরানা নির্ধারণ করেছিলেন সাধারণ ও সহজভাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রীদের দেনমোহর ছিল ৫০০ দিরহাম (প্রায় দেড় কেজি রূপার সমমূল্য)। (সহীহ মুসলিম: ১৪২৬)

তিনি সাহাবীদেরও সহজ দেনমোহর করতে উৎসাহিত করেছেন। হাদীসে এসেছে—
“তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বরকতময় বিবাহ সেইটি, যেখানে দেনমোহর সবচেয়ে সহজ।”
(ইবনে মাজাহ: ১৮৮৭)

এক সাহাবী যখন রাসূল ﷺ–এর কাছে এসে বললেন যে, তাঁর কাছে মোহরানার জন্য অর্থ নেই, তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার কাছে কুরআনের কোনো সূরা আছে?” সাহাবী বললেন: “হ্যাঁ।”
তখন তিনি বললেন: “তাহলে আমি তোমাকে ওই সূরার শিক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে বিয়ে দিলাম।”
(সহীহ বুখারী: ৫১৪৯)

এ থেকে বোঝা যায়, মোহরানা কেবল টাকা–পয়সা নয়; এটি হতে পারে সম্পদ, সোনা–রূপা, কিংবা এমনকি কুরআনের শিক্ষা।


সাহাবীগণের মোহরানা

  • হযরত আলী (রা.) ফাতিমা (রা.)–কে বিয়ের সময় তাঁর যুদ্ধের বর্মকে মোহরানা হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন।
  • সাহাবীগণ অনেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী স্বল্প মোহরানা দিতেন।
  • ইতিহাসে দেখা যায়, কারও মোহরানা ছিল একজোড়া জুতো, কারও ছিল খেজুরের বাগান থেকে কিছু খেজুর।

মোহরানার মূল উদ্দেশ্য হলো দায়িত্বশীলতা প্রকাশ, বিলাসিতা নয়।

মোহরানা সম্পর্কিত ইসলাম

মোহরানার ধরন ও পরিমাণ

ইসলামে মোহরানার নির্দিষ্ট সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত নেই। তবে সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে।

মোহরানার ধরন হতে পারে—

  1. মোহরানা মো‘জ্জাল (তাৎক্ষণিক): বিয়ের সময় পরিশোধ করতে হয়।
  2. মোহরানা মুওয়াজ্জাল (পরে প্রদেয়): পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সময়ে দেওয়া হয়।
  3. আংশিক এখন + আংশিক পরে: বাস্তবতা অনুযায়ী উভয়ের সম্মতিতে।

একথা মনে রাখা জরুরি যে, মোহরানা স্ত্রীকে বিয়ের মুহূর্ত থেকেই প্রাপ্য। যদি পরবর্তীতে তালাক বা মৃত্যু ঘটে, তবে স্ত্রী মোহরানা দাবি করতে পারবেন।


মোহরানার প্রয়োজনীয়তা ও উদ্দেশ্য

১. নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা

মোহরানা নারীকে ইসলামে একটি সম্মানজনক স্থান দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে, বিবাহের মাধ্যমে নারী কোনো বোঝা নয়; বরং তাঁর নিজস্ব অধিকার রয়েছে।

২. সম্মান ও মর্যাদা

মোহরানা হলো স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক। এটি ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতার প্রতীকী উপহার।

৩. দায়িত্বশীলতা

স্বামীকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বিবাহ কেবল আনন্দের নাম নয়; বরং এটি দায়িত্বপূর্ণ চুক্তি।

৪. আর্থিক নিরাপত্তা

মোহরানা নারীর জন্য জরুরি প্রয়োজনে একটি সঞ্চয় বা নিরাপত্তার মাধ্যম। বিশেষত তালাক বা স্বামীর মৃত্যু হলে এটি নারীর সহায় হয়ে দাঁড়ায়।

৫. সামাজিক ভারসাম্য

মোহরানা সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করে। এটি বিবাহকে দায়িত্বপূর্ণ করে তোলে এবং নারীকে অবহেলার হাত থেকে রক্ষা করে।

মোহরানা সম্পর্কিত ইসলাম

প্রশ্নোত্তর: মোহরানা সম্পর্কিত কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা

❓ মোহরানা না দিলে কি বিয়ে বৈধ?

হ্যাঁ, বিয়ে বৈধ হবে। তবে মোহরানা স্ত্রীর অধিকার হিসেবে প্রাপ্য থাকবে এবং পরবর্তীতে দিতে বাধ্যতামূলক হবে।

❓ মোহরানা কি কেবল টাকা হতে হবে?

না। এটি হতে পারে অর্থ, সম্পদ, সোনা–রূপা, অথবা এমনকি শিক্ষা (যেমন কুরআন শিক্ষা)।

❓ স্ত্রী মোহরানা মাফ করলে কী হবে?

কুরআনে বলা হয়েছে, যদি স্ত্রী খুশিমনে মোহরানা মাফ করে দেন, তবে স্বামী তা থেকে মুক্ত হবেন। তবে এটি জোরপূর্বক মাফ করানো যাবে না।

❓ খুব বেশি মোহরানা নির্ধারণ করলে কি ভালো?

না। বরং এটি অনেক সময় বিবাহে জটিলতা তৈরি করে। রাসূল ﷺ সহজ মোহরানা করতে উৎসাহ দিয়েছেন।


আধুনিক সমাজে মোহরানার বাস্তবতা

আজকের সমাজে দেখা যায়—

  • অনেক পরিবার মোহরানাকে কেবল কাগজে লিখে রাখে, আদায় করে না।
  • কোথাও আবার মোহরানা অযথা কোটি কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা কখনোই দেওয়া হয় না।
  • আবার কেউ কেউ খুবই কম নির্ধারণ করেন, যা নারীর সম্মানকে খাটো করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক হলো—
সহজ, বাস্তবসম্মত এবং সামর্থ্য অনুযায়ী মোহরানা নির্ধারণ করা।


কিছু ভুল ধারণা ও সংশোধন

  1. ভুল ধারণা: মোহরানা শুধু কাগজে লিখে রাখলেই যথেষ্ট।
    • সংশোধন: এটি স্ত্রীর অধিকার, যা আদায় করতে হবে।
  2. ভুল ধারণা: মোহরানা শুধু টাকা।
    • সংশোধন: এটি হতে পারে সোনা–রূপা, সম্পদ, বা শিক্ষা।
  3. ভুল ধারণা: বেশি মোহরানা মানেই বেশি সম্মান।
    • সংশোধন: প্রকৃত সম্মান হলো বাস্তবসম্মত ও সহজ মোহরানায়।

উপসংহার

মোহরানা ইসলামে কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি নারীর অধিকার, স্বামীর দায়িত্ব এবং বিবাহের অপরিহার্য অংশ। কুরআন ও হাদীসের আলোকে বোঝা যায়, মোহরানা প্রদান করা কোনো ঐচ্ছিক কাজ নয়, বরং ফরজ দায়িত্ব।

আজকের সমাজে মোহরানাকে বোঝা বা প্রতিযোগিতার বিষয় না বানিয়ে, বরং ইসলামের সহজ–সরল নির্দেশনা অনুযায়ী বাস্তবসম্মতভাবে নির্ধারণ করা জরুরি। এতে নারী তার অধিকার পাবেন, স্বামী তার দায়িত্ব পূর্ণ করবেন, আর সমাজে ন্যায়বিচার ও পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *